Tuesday, 6 December 2011

কিডনি ফিরিয়ে দাও




           [ সুসজ্জিত চেম্বারে ডাক্তারবাবু উপবিষ্ট। তাঁর আচরণে একটা অধৈর্যের ছাপ। মাঝে মাঝে পায়চারী করছেন, মাঝে মাঝে চেয়ারে বসছেন আবার পায়চারী করছেন]

ডাক্তার।। ভজা, ভজা।

ভজা।। (নেপথ্যে) আজ্ঞে যাই সার। ( ভজার প্রবেশ) কি বলছেন সার?

ডাক্তার।। কি বলছেন সার। বলছি আমার মাথা আর মুণ্ডু। পেশেন্টগুলোকে এক এক করে পাঠাতে পারছ না? সব কি আমায় বলে দিতে হবে? রাস্কেল।

ভজা।। আজ্ঞে আপনিই তো সেদিন বললেন পেশেন্টদেরকে অপেক্ষা করিয়ে রাখলে ডাক্তারের উপরে তাদের ছেদ্দাভক্তি বাড়ে।

ডাক্তার।। শাট আপ, তুই তো আমাকেও অপেক্ষা করিয়ে রাখছিস। এদিকে রাত নটায় দি হেল নারসিং হোমে আমার একটা জরুরী অপারেশন আছে।

ভজা।। তা সেই পেসেন্টও অপেক্ষা করুক না।

ডাক্তার।। আজ্ঞে না। নটার আগে ওখানে পৌঁছতেই হবে। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ভজা।। কেন কেন সার? দেরী হলে পেশেন্ট মারা যাবে?

ডাক্তার।। না সার। দেরী হলে পেশেন্ট এমনিই ভাল হয়ে যাবে, অপারেশন করবার আর দরকারই হবে না। (ভজার হাস্য) দাঁত বের করে হাসছিস যে? যা পেশেন্ট গুলোকে এক এক করে পাঠিয়ে দে। গাধা কোথাকার।

(ভজার প্রস্থান, প্রথম রোগীর প্রবেশ)

রোগী।। উঃ আঃ ডাক্তারবাবু

ডাক্তার।। কি হয়েছে আপনার?

রোগী।। উঃ আঃ মরে গেলাম, হাঁটুতে ব্যথা।

ডাক্তার।। কোন হাঁটুতে ব্যথা?

রোগী।। উঃ আঃ এইযে। (হাত দিয়ে দেখাল)

ডাক্তার।। হুম! ডান হাঁটুতে ব্যথা। কিন্তু আমি তো বাঁ হাঁটুর স্পেশালিষ্ট। ডান হাঁটুর ট্রিটমেন্ট তো আমি করি না।

রোগী।। উঃ আঃ তাহলে আমার কি হবে ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার।। চিন্তার কিছু নেই। আমি একজন ভাল ডান হাঁটুর স্পেশালিষ্টকে রেফার করে দিচ্ছি। (কাগজ টেনে নিয়ে খসখস করে লিখতে লিখতে) ডক্টর প্যাটেলা, হাড়কাটা লেন। হুমম হুমম। ওনাকে দেখাবেন, হাঁটুর ব্যথা সেরে যাবে। আমার ফিসটা দিয়ে যান, পাঁচশো, থ্যাংকিউ।

(প্রথম রোগীর প্রস্থান, দ্বিতীয় রোগীর প্রবেশ)

রোগী।। হিহিহিহি।হুহুহুহু।

ডাক্তার।। বলুন কি হয়েছে।

রোগী।। হিহি হুহু, ডাক্তারবাবু, ভীষণ জ্বর।

ডাক্তার।। কত দিন ধরে জ্বর?

রোগী।। হিহি, তা হুহু প্রায় পাঁচদিন হল, হুহুহু।

ডাক্তার।। দেখি, শুয়ে পড়ুন (রোগীকে শুইয়ে কিছুক্ষন যথাবিহিত চেকআপের পর প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে) যে ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি নিয়ম করে খাবেন। ব্লাড ইউরিন স্টুল পরীক্ষা করাবেন, এক্সরে ইসিজি আলট্রা সোনোগ্রাফি করাবেন, আমাদের শমনভবন থেকেই করাবেন, অন্য কোথাও করালে আমি দেখব না।

রোগী।। সোনোস্কোপি করতে হবে ডাক্তারবাবু?            
                                                                                     
ডাক্তার।। উঁ? ও হ্যাঁ ভালো কথা, বায়পসিও করাতে হবে।

রোগী।। বায়স্কোপিও করাতে হবে?

ডাক্তার।। হ্যাঁ।

রোগী।। বায়স্কোপি সোনোস্কোপি দুটোই করাতে হবে?

ডাক্তার।। হ্যাঁ হ্যাঁ, বললাম তো, এতো বকাচ্ছেন কেন?

রোগী।। আমার কি হয়েছে ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার।। কি হয়েছে তা জানার জন্যই ত পরীক্ষাগুলো করাতে বলছি, আমি কি জ্যোতিষী নাকি যে আগেই সব বলে দেব? যত্ত সব।

রোগী।। আহা উহুহুহু। রাগ করছেন কেন ডাক্তারবাবু, আমি বলছি আমার টাইফয়েড হয় নি তো?

ডাক্তার।। হুমমম। হতে পারে। রিপোর্ট না দেখে তো কিছু বলা যাবে না।

রোগী।। হে ভগবান। হুহুহু আর যা কিছু হোক টাইফয়েড যেন না হয়।

ডাক্তার।। কেন বলুন তো, টাইফয়েডকে এত ভয় পাচ্ছেন কেন?

রোগী।। আমি একজন মহিলাকে চিনতাম, ওর নাম রুমনি সেন। টাইফয়েডের চিকিচ্ছে করাতে গিয়ে বেচারার হার্টের ব্যামোয় প্রাণটা গেল।

ডাক্তার।। আমি অমন কাঁচা কাজ করিনা। আমার কাছে টাইফয়েডের ট্রিটমেন্ট করাতে এলে টাইফয়েডেই মারা যাবেন, অন্য কোন রোগে নয়। (রোগী প্রস্থানোদ্যত) একি? চলে যাচ্ছেন যে? আমার ফিসটা দিয়ে যান, পাঁচশো, হ্যাঁ ঠিক আছে।

(দ্বিতীয় রোগীর প্রস্থান, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রবেশ)

রিপ্রে।। নমস্কার ডাক্তারবাবু। আমাদের কোম্পানির নতুন একটি প্রডাক্ট নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। এই যে (কাগজপত্র প্রদান)

ডাক্তার।। হুমম, স্যালাইনের বটল, কিন্তু আমি তো টেক আন্ড ডাই কোম্পানির স্যালাইনই ব্যবহার করি। ওরা আমাকে টুয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট কমিশন দেয়।

রিপ্রে।। মাত্র? আমরা দেব ফরটি পারসেন্ট।

ডাক্তার।। বটে বটে? সত্যি বলছেন?

রিপ্রে।। ইয়েস, তা ছাড়া আমাদের কিছু গিফট অফারও আছে। প্রতি স্যালাইনের বটল পিছু দুটো করে কেঁচো।

ডাক্তার।। ও যতই গিফট দিন, পেশেন্টদের মন পাওয়া খুবই কঠিন, বেইমানের ঝাড় সব।

রিপ্রে।। ঠিক বলেছেন ডাক্তার বাবু।

ডাক্তার।। পেশেন্ট যদি চিকিৎসায় ভাল হয়ে যায় তখন ডাক্তারের নাম করে না, কিন্তু যদি তা না হয় তখন মার শালা ডাক্তারকে।

রিপ্রে।। ঠিক ঠিক খুবই খাঁটি কথা বলেছেন ডাক্তার বাবু।

ডাক্তার।। এইতো দেখুন না, বছর পাঁচেক আগে আমার কাছে এক পেশেন্ট এসেছিল সারভাইকাল ক্যানসার। একেবারে থার্ড স্টেজ। আমি অপারেশন করে বাঁচানর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যাড লাক বাঁচল না। তারপর পেশেন্টের হাসবান্ড আমার এগেন্সটে কেস করল, সেই কেস এখনও চলছে। কিরকম বেইমান, একবার ভেবে দেখুন।

রিপ্রে।। তা ঠিক। তাহলে আমি আসি? ওই কথাই রইল, ফরটি পারসেন্ট, কেমন?

ডাক্তার।। (বিগলিতভাবে) হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চই, নিশ্চই।

(মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রস্থান, তৃতীয় রোগীর প্রবেশ, রোগা, শুঁটকো চেহারা, ছেঁড়া জামা, সর্বাঙ্গে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট)

ডাক্তার।। কি হয়েছ্যা তোমার?

রোগী।। ডাক্তারবাবু, আমার বুকে ভীষণ ব্যথা।

ডাক্তার।। আমার ফিস পাঁচশো টাকা। দিতে পারব্যা?

রোগী।। না ডাক্তারবাবু, আমার কাছে কুড়িয়ে বাড়িয়ে মাত্র একশো টাকাই আছে।

ডাক্তার।। তাহলে আমার কাছে এসেছ কেন? যাও, (রোগী প্রস্থানোদ্যত) আচ্ছা, দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমাকে রিচুর কাছে পাঠাই, রিচুও খুশি হবে। বেচারা নতুন চেম্বার খুলেছে, রুগিপত্তর তেমন হয় না। আমি লিখে দিচ্ছিহুম হুম। ডক্টর রিচপ্র্যাম, পঞ্চাননতলা। ওকে দেখাও, ওর ফিস অনেক কম। যাও আমাকে ফিস দিতে হবে না। (স্বগত গর্বিতভাবে) নাঃ এত ডাক্তার দেখলাম, কিন্তু আমার মত দয়ালু ডাক্তার একটাও দেখলাম না।

(তৃতীয় রোগীর প্রস্থান, চতুর্থ রোগিণীর প্রবেশ)

ডাক্তার।।  কি হয়েছে বলুন, ও হ্যাঁ, আপনিই তো সেই পেটব্যথা। রিপোর্ট এনেছেন?

রোগিণী।। হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, এই যে।

ডাক্তার।। দেখি। হুম হুম। কিছু তো বোঝা যাচ্ছে না। আমি আশা করেছিলাম ইউটেরাসে টিউমার।

রোগিণী।। অ্যাঁ কি বলছেন ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার।। বলছি ইউটেরাসে তো কিছু হয় নি, তাহলে আমি জানি না, আপনি বরং ডক্টর কিলারকে দেখান। খুব ভাল ডাক্তার।

রোগিণী।। পাঁচ হাজার টাকা আমার বেরিয়ে গেল শুধু এতগুলো টেস্ট করাতে। এখন আপনি বলছেন আপনি কিছু জানেন না?

ডাক্তার।। আহা, এইটাই আপনাদের দোষ, এতটুকু ধৈর্য নেই, খালি ফোঁস ফোঁস করতে শিখেছেন। আমি তো বলছি ডক্টর কিলার দারুণ ভাল ডাক্তার, আমার ভীষণ ভাল বন্ধু, ওকে দেখান, নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবেন। (স্বগত) একবার কেস খেয়ে গেছি সেই জ্বালায় এখনও জ্বলে মরছি। আর বেশি জ্বলতে চাই না, ও কিলারই দেখুক।

রোগিণী।। ঠিক আছে। ডক্টর কিলারকেই দেখাব। (প্রস্থানোদ্যত)

ডাক্তার।। আরে আরে যাচ্ছেন কোথায়, আমার ফিসটা দিয়ে যান।

রোগিণী।। ডক্টর কিলারকেই দেব। (প্রস্থান)

ডাক্তার।। (সগর্জনে) ভজা, ভজা। (ভজার প্রবেশ) এইসব অসভ্য পেশেন্টদের ঢুকতে দিস কেন?

ভজা।। অসভ্যতা করেছেন বুঝি? তা আমি কি করে বুঝব সার?

ডাক্তার।। কি করে বুঝব সার। অপদার্থ।

ভজা।। বারে আমি কি করলাম, শুধু শুধু আমায় বকছেন কেন?

ডাক্তার।। হয়েছে হয়েছে, যা। আর কটা আছে?

ভজা।। একটা।

ডাক্তার।। যা পাঠিয়ে দে।

(ভজার প্রস্থান পঞ্চম রোগিণীর প্রবেশ)  

ডাক্তার।। (স্বগত) আরে ওয়াহ, এ তো দেখছি বেশ সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী। (প্রকাশ্যে) এস, এস, শোবে এস। (রোগিণীর শয়ন)

ডাক্তার।। (রোগিণীর খুব কাছে দাঁড়িয়ে ঘনিষ্ঠভাবে) তা হ্যাঁ গা, কি হয়েছে গা তোমার?

রোগিণী।। ডাক্তারবাবু, আপনি ভগবান। আপনার অনেক প্রশংসা শুনে অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি আমায় বাঁচান।

ডাক্তার।। (খুশী হয়ে) তাই বুঝি? তা কার কাছে আমার প্রশংসা শুনলে?

রোগিণী।। ডক্টর কৃতান্ত কুণ্ডু, ভাঙাঘাটে বসেন।

ডাক্তার।। কৃতান্ত? এ নামে ত কাউকে চিনি না। তা যাকগে তোমার কি হয়েছে তাই বল।

রোগিণী।। পাঁচ বছর আগে আমার ইউটেরাস অপারেশন হয়েছিল। তারপর থেকে পেটে এত ব্যথা এত যন্ত্রণা হয়ে চলেছে যে আমি আর সহ্য করতে পারছি না, মনে হচ্ছে এর থেকে মরে গেলে ভাল ছিল। মাঝে মাঝে এও মনে হয়, আমি বুঝি আর বেঁচে নেই, একেবারে মরেই গেছি।

ডাক্তার।। হুম, খুবই সিরিয়াস কেস মনে হচ্ছে। খুবই চিন্তার বিষয়। মনে হচ্ছে আর একটা অপারেশন করতে হবে। হুম দেখি (যথাবিহিত চেকআপ) ।

রোগিণী।। আবার কি অপারেশন করবেন ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার।। উঁহু, কথা বোলো না, জোরে শ্বাস, হুম পেটের কোথায় ব্যথা?

রোগিণী।। এই খানে।

ডাক্তার।। এই খানে? দেখি, (হঠাৎ আতংকিত হয়ে) একি!পেট টা এমন বীভৎস ভাবে কাটা কেন? স্টমাক, স্প্লিন, লিভার সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অথচ এক ফোঁটা রক্ত নেই, কিডনি...... কিডনিও নেই। একি একি...... (রোগিণী ধীরে ধীরে উঠে বসে, মুখে ভয়ঙ্কর হাসি) আরে এ তো সেই পেশেন্ট পাঁচ বছর আগে যার ইউটেরাস অপারেশন করবার সময় আমি যার দুটো কিডনিই তুলে নিয়েছিলাম, ওরে বাবারে, ভুউউউ ভুউউউ......বাবাবাঁচাও...... ভজা ভজা।

[ডাক্তার চিৎকার করে পালাতে চেষ্টা করে। রোগিণী তাকে ধরার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টা চলাকালীন রোগিণী একটা গান ধরে, পুরনো হিন্দি গানের(আপ কি নজর নে সমঝা প্যার কি কাবিল মুঝে) সুরে.........]

রোগিণী।। অভাগিনীর পরে এত দয়া কেন জানি না,
       কি অপারেট করবে সেটা একটু খুলে বল না।
       ইউটেরাসটা নিতে পারো কিডনি আমি দেব না,
      কিডনি আমার নিলে কেন দাও ফিরিয়ে দাও না।।

সমাপ্ত

Roomnee Sen